শাপলা: এক আঁধার রাতের উপাখ্যান

শাপলা: এক আঁধার রাতের উপাখ্যান

মোহাম্মদপুরের বাইতুল ফযল মাদরাসার ৮ম শ্রেণির ছাত্র মো: সাইদুল বারী। খালার বাসায় থাকত। হঠাৎ একদিন মাদরাসা থেকে বাসায় ফিরল না সে। তার মোবাইলও সুইচড অফ। চিন্তিত হয়ে তার খালাতো বোন মাদরাসায় ফোন করলে জানা যায় সে মাদরাসায়ও নেই। পরদিন বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে দেখা যায় গতকাল রাতে ঢাকার মতিঝিল এলাকায় অসংখ্য মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছে সরকারি বাহিনী। এর পরদিন সাইদুলের খোঁজ পাওয়া যায়। মতিঝিলে ইসলামী ব্যাংক হসপিটালের মর্গে পড়ে ছিল তার নিথর দেহ। মাথার পেছনে ভারি বস্তু দিয়ে মারাত্মক আঘাতের চিহ্ন। সামনের দিকে ধারালো লম্বা কিছু দিয়ে করা ক্ষত, থুঁতনিতে দু’ইঞ্চি লম্বা ছুরিকাঘাতের চিহ্ন।

মোয়াজ্জেমুল হক নান্নু। বন্ধুর সাথে সেদিন মতিঝিল গিয়েছিল সেও। এজন্য আগের দিন যশোর থেকে ঢাকায় বন্ধুর বাসায় আসে নান্নু। মতিঝিল যাওয়ার পর থেকে তার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তার পরিবারের। পরদিন ভোরে অপরিচিত এক ব্যক্তি্র কল আসে তার ভাই মো: হাফিজুল হকের মোবাইলে। জানা যায় নান্নু গুলিবিদ্ধ হয়ে মোহাম্মদপুরের আল মানার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। অপারেশনের পরেও নান্নুর অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল না। এদিকে পরিবারেরও সামর্থ্য নেই তাকে ঢাকায় রেখে চিকিৎসা করাবার। বাধ্য হয়ে নান্নুকে যশোর নিয়ে আসা হয়। সেদিনই নান্নু মারা যায়। তার শরীরে অসংখ্য জখমের চিহ্ন। বুকে, পায়ে আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট। অমানবিক নির্যাতনের পর খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছিল তাকে।[১]

রেহান আহসান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের ছাত্র। অনেকের মতো রেহানও সেদিন গিয়েছিল মতিঝিল। সাথে কয়েকজন বন্ধু ছিল। বিকেলে মায়ের সাথে কলে কথা হয় তার। এরপর থেকে তার ছেলের খোঁজ পাচ্ছিলেন না ইফফাত আরা বেগম। রেহানের বন্ধুদের সাথে নিয়ে সারা রাত ছেলের খোঁজে ছোটাছুটি করেন তিনি। শেষমেশ ফজরের পর তার ছেলেকে খুঁজে পেলেন ইফফাত আরা। মাথায় গুলিবিদ্ধ ছেলের রক্তাক্ত দেহটা পড়ে ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে।[২]

বলছিলাম ২০১৩ সালের ৫-ই মের কথা। সাইদুল, নান্নু, রেহানের মতো অনেকেই সেদিন নাস্তিক ব্লগারদের নবী অবমাননার প্রতিবাদে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে একত্রিত হয়েছিল। তারা সেখানে কেবল আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর প্রতি ভালোবাসা থেকে সেখানে গিয়েছিল। তাদের মূল দাবি ছিল একটা – নবী অবমাননাকারীদের শাস্তি। কিন্তু নবীর প্রতি ভালোবাসার এই প্রতিফলনের কারণেই রাক্ষসী হাসিনা তাদের উপর খড়গহস্ত হয়। গভীর রাতে মিডিয়া, ইন্টারনেট, আলো বন্ধ করে সরকারি বাহিনী এবং আওয়ামী ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে সেদিন শাপলা চত্বরে চালায় নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ। বাংলাদেশের ইতিহাসে ইসলাম ও মুসলিমদের দমন করার এই ঘটনা নজিরবিহীন। সেদিন ছিল এদেশের মুসলিমদের জন্য এক তিমির রাত। হয়তো সেদিন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল জালিমের পতনের কাউন্টডাউন।

চলো, প্রবেশ করি ইতিহাসের সেই রক্তাক্ত অধ্যায়ে।

পটভূমি

২০০৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট ক্ষমতায় আসে। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার লক্ষ্যে হাসিনা সরকার গঠন করে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীকে দমন করার এক পরিকল্পনার অংশ ছিল এই ট্রাইব্যুনাল। ২০১৩ সালের ৫-ই ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লাকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। এই রায়ের প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে ব্লগার এন্ড অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নেটওয়ার্ক (BOAN) শাহবাগ এলাকায় অবস্থান নেয়। তারা যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ডের দাবি করে। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই আন্দোলন দেশব্যপী ছড়িয়ে পড়ে। সরকারের সমর্থন ও ব্যাপক মিডিয়া কভারেজ লাভ করে। ১৪ দলীয় জোট সরকার আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানায়।  তথাকথিত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মী ও শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে যোগ দেয়। আন্দোলন থেকে ইমরান এইচ সরকারকে মুখপাত্র করে ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ নামে এক সংগঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়।[৩]

৮ তারিখ আন্দোলন এক নতুন মাত্রা পায়। প্রায় এক লক্ষাধিক মানুষ শাহবাগে সমবেত হয়।[৪] ১২ তারিখ বিকেল ৪টা থেকে পুরো দেশ জুড়ে ৩ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।[৫] আন্দোলনে দাড়ি-টুপি ও হিজাবের মতো ইসলামী চিহ্নের অবমাননা ছিল চোখে পড়ার মতো। ১৪ ফেব্রুয়ারি দারুল উলূম হাটহাজারির বার্ষিক মাহফিলে একযোগে সব বক্তাগণ শাহবাগের ঔদ্ধত্য আচরণের প্রতিবাদ জানান। মাহফিলের প্রধান বক্তা ছিলেন হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহিমাহুল্লাহ)।[৬] ১৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও নাস্তিক ব্লগার রাজিব হায়দার ওরফে থাবা বাবা হত্যার শিকার হলে পরিস্থিতি উত্তাল হয়ে ওঠে। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা রাজিবের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে এবং তাকে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ’ উপাধি দেয়।[৭] এদিকে দৈনিক আমার দেশ, দৈনিক ইনকিলাব, দৈনিক নয়াদিগন্তদৈনিক সংগ্রাম-এর মতো পত্রিকা থাবা বাবার ইসলামবিদ্বেষী ও নবীকে অপমান করা লেখাগুলো প্রকাশ করলে দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।[৮] বিভিন্ন ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সংগঠন বিবৃতি দিয়ে এর তীব্র নিন্দা জানায়। ১৯ ফেব্রুয়ারি আমার দেশ পত্রিকার প্রথম পাতায় হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা আহমদ শফীর (রহিমাহুল্লাহ) খোলাচিঠি প্রকশিত হয়।[৯]

২১ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ থেকে আন্দোলনকারীরা জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি তোলে। সমাবেশ থেকে তারা ২৬ মার্চ আল্টিমেটাম বেঁধে দেয়। ২২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার ঢাকার বায়তুল মুকাররমের উত্তর গেইটে হেফাজতে ইসলাম এবং সমমনা ১২টি ইসলামী দল বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেয়। কিন্তু পুলিশি বাধায় তা পণ্ড হয়ে যায়। শাহবাগ আন্দোলনকারীদের সন্তুষ্ট করতে ও রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর আল্লামা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। এই প্রহসনের বিচারের বিরুদ্ধে জামায়াত ও ছাত্র শিবিরের কর্মীরা রাজপথে নামে। দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়। দেশজুড়ে চলে পুলিশি নির্যাতন, হত্যা ও ধরপাকড়।[১০] 

৯ মার্চ হাটহাজারি মাদরাসায় হেফাজতে ইসলামের আয়োজিত ওলামা সম্মেলনে সরকারের কাছে ১৩ দফা দাবি পেশ করা হয়। ১৩ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ৬ এপ্রিল ঢাকা অভিমুখে ঐতিহাসিক লংমার্চের ডাক দেয় হেফাজতে ইসলাম।[১১] সারা দেশ থেকে অগণিত মানুষ যোগ দেয় এই লংমার্চে। লংমার্চ শেষে শাপলা চত্বরের মহাসমাবেশ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, যদি ৩০শে এপ্রিলের মধ্যে সরকার তাদের দাবি মেনে না নেয়, তাহলে ৫-ই মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হবে। 

হত্যাযজ্ঞ

পূর্বঘোষিত কর্মসূচি মোতাবেক ৫-ই মে হেফাজতের নেতাকর্মীরা ঢাকায় প্রবেশ করতে শুরু করে। সারা দেশ থেকে তাদের সাথে যুক্ত হয় অসংখ্য নবীপ্রেমিক মুসলিম। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বায়তুল মুকাররমে আল্লামা শফীর নেতৃত্বে একটি দুআ আয়োজন করা। দুপুরে মতিঝিলের শাপলা চত্বরের দিকে যাওয়ার সময় আওয়ামী ও ছাত্রলীগের গুণ্ডাদের আক্রমণের শিকার হয় সমাবেশে যোগদানকারীরা। আক্রমণকারীদের হাতে রামদা, চাপাতি ও পিস্তলের মতো অস্ত্র ছিল। পুলিশের সদস্যরা তাদের সাহায্য করে। এ সময় পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের গুলিতে অনেকে আহত ও নিহত হয়। 

দুপুর ৩টা থেকে শাপলা চত্বরে হেফাজতের নেতারা বক্তৃতা দেওয়া শুরু করেন। সন্ধ্যায় শেষ করার কথা থাকলেও তা শেষ হয় ঈশার সালাতের আগে রাত ৮ টায়। সাড়ে ৮টা নাগাদ মতিঝিল থানা পুলিশ হেফাজত কর্মীদের উপর চড়াও হয় ও গুলি চালায়। বেশ কয়েকজন নিহত হয়। হেফাজত নেতারা মেগাফোনে পুলিশকে অনুরোধ করে গুলি না চালাতে। রাত ১১টা নাগাদ পরিস্থিতি শান্ত হয়। হেফাজত কর্মীরা রাতটা শাপলা চত্বরেই কাটিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। 

রাত সাড়ে ১২টার দিকে মতিঝিল ও আশপাশের এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। মেগাফোনের লাইন কেটে দেওয়া হয়।  রাত ২:১৫ তে প্রায় ১০,০০০ পুলিশ, র‍্যাব ও বিজিবির যৌথ বাহিনী নিরস্ত্র, ঘুমন্ত ও যিকিররত হেফাজত কর্মীদের উপর চালায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ। দৈনিক বাংলা, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ফকিরাপুল – তিন দিক থেকে হামলা চালায় তারা। গুলি, টিয়ার গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড এবং গরম পানি ব্যবহার করা হয়। র‍্যাব এই নারকীয় গণহত্যার নাম দেয় ‘অপারেশন ফ্ল্যাশ আউট’। শত শত মানুষ হত্যার পর চলে পানি দিয়ে পরিষ্কার অভিযান। বেঁচে যাওয়াদের লাঞ্ছিত করতে কান ধরে মতিঝিল এলাকা থেকে বের করে দেওয়া হয়।[১২]

হতাহতের সংখ্যা

ঐ আঁধার রাতে জালিমের বাহিনীর হাতে নিহত শহীদদের সঠিক সংখ্যা আজও জানা যায়নি। অসংখ্য মানুষ নিখোঁজ। আজও তাদের খবর পায়নি তাদের পরিবার। অগণিত মাদরাসার শিশু-কিশোরও নিহত হয় সেই রাতে। লাশও পাওয়া যায়নি তাদের। যাবে কীভাবে? হত্যা করার পর লাশও গুম করে দেওয়া হয়। তৎকালীন র‍্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক এবং অপারেশন ফ্ল্যাশ আউটের দায়িত্বে থাকা লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউল আহসানের ব্যাচমেইট মেজর (অব.) সুমন আহমেদের মতে, লাশগুলো নিয়ে কক্সবাজার সমুদ্রে, ঢাকা-কুমিল্লা ব্রিজের নিচে ও টুকরো টুকরো করে বিভিন্ন জায়গায় ফেলে দেওয়া হয়।[১৩]

সরকারের দেওয়া তথ্যমতে মৃতের সংখ্যা ১১[১৪], আল-জাজিরার মতে সংখ্যাটি ৫০-এর বেশি[১৫]। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার ৬১ জন নিহতের নাম প্রকাশ করে। হেফাজতের এক কর্মী অধিকারকে জানায়, ২০২ জন নিহত হয়েছে ও প্রায় ২৫০০ জন নিখোঁজ।[১৬] জিটিভি নিউজের রিপোর্ট মতে, সংখ্যাটি ৩০০ এর কম না।[১৭] তবে নিখোঁজ এবং নিহতের সঠিক সংখ্যা আজও অজানা।

এই হত্যাযজ্ঞের পর সংসদে দাঁড়িয়ে হাসিনা কৌতুক করে বলেছিল, ‘সেদিন কোনো গোলাগুলি বা সে রকম কোনো ঘটনাই ঘটেনি… গায়ে লাল রং লাগিয়ে পড়ে আছে, যখন পুলিশ যেয়ে ডাক দিছে উঠে দৌড় মারছে। দেখা গেল লাশ দৌড় মারল।’ 

মিডিয়া

মূলধারার অধিকাংশ মিডিয়া সরকারের পক্ষ নেয়। তারা হেফাজতের শান্তিপূর্ণ সমাবেশকে ‘তাণ্ডব’ বলে প্রচার করে। ৫ তারিখ বায়তুল মুকাররমের আশেপাশের ইসলামী বইয়ের দোকানে আগুন লাগিয়ে কুরআন জ্বালিয়ে দেয় আওয়ামী কর্মীরা। অথচ পক্ষপাতদুষ্ট মিডিয়া এই দোষ হেফাজতের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। ৬ মে’র প্রায় সবক’টি পত্রিকা অপারেশন সংক্রান্ত খবরগুলোর বহু নাটকীয় শিরোনাম দেওয়ার চেষ্টা করলেও বেশিরভাগ পত্রিকাই তাদের শিরোনামে হতাহতের কোনো তথ্যই দেয়নি। শিরোনামগুলো পড়ে মনে হবে অপারেশনটি অত্যন্ত ‘শান্তিপূর্ণ’ ছিল! যেমন: জনকণ্ঠের শিরোনাম ‘দশ মিনিটেই শাপলা চত্বর মুক্ত’, সমকালের শিরোনাম ‘১০ মিনিটের সাঁড়াশি অভিযান’, কালেরকণ্ঠ ‘রুদ্ধশ্বাস আধাঘণ্টা’, যুগান্তর ‘অপারেশন মিডনাইট : শ্বাসরুদ্ধকর ১ ঘণ্টা’। ১২ মে রোববারের যুগান্তর পত্রিকায় ৬ কলামে লিড খবরের শিরোনাম ছিল ‘দেড় লক্ষাধিক গোলাবারুদ ব্যবহার, হেফাজত দমনে সরাসরি অংশ নেয় ৭ হাজার ৫৮৮ সদস্য’। কিন্তু সেখানেও হতাহতের কোনো সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি।[১৮] অথচ ৬ মে প্রথম আলো নিহতের কথা না বললেও হেফাজতের গাছ কাটার তীব্র নিন্দা জানায়।[১৯] Daily Star মাত্র ৫ জন হতাহতের কথা উল্লেখ করে।[২০] ৫-ই মে রাতের নৃশংসতা সরাসরি সম্প্রচার করায় সে রাতেই ইসলামিক টিভিদিগন্ত টেলিভিশন সরকার বন্ধ করে দেয়।[২১] 

বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ

দেশের নামকরা বুদ্ধিজীবীরা সে সময় শাহবাগ আন্দোলনকে সমর্থন করে। জাফর ইকবাল, আনিসুল হক, আনু মুহাম্মদ প্রমূখ শাহবাগ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন। তারা ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বনাম রাজাকার’ এই বয়ানে ইসলামকে মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে দাঁড় করায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে ইসলাম বিদ্বেষের বিষবাষ্প ছড়ায়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় চালানো হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতায় যারা এত সরব, ৫-ই মে’র হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তাদের নীরবতা ছিল চোখে পড়ার মতো। ৫-ই মে শাপলা চত্বরে যাওয়ার পথে যখন মুসলিমরা পুলিশ ও লীগের আক্রমণের শিকার হচ্ছিল, বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ তখন শাহবাগ আন্দোলনের ৩ মাস পূর্তি উদযাপন করছিল শাহবাগে।[২২] হত্যাযজ্ঞ পরবর্তী সময়ও গুটি কয়েকজন ছাড়া পুরো বুদ্ধিজীবী ও সুশীল মহলে ছিল পিনপতন নীরিবতা। এর মাধ্যমে তারা শাপলা ম্যাসাকারের পক্ষে মূলত মৌন সম্মতি দিয়েছে। এরপরের বছরগুলোয় হাসিনার জুলুম বাড়তে থাকে। জঙ্গি বয়ানের মাধ্যমে মুসলিমদের গুম, ক্রস ফায়ার, আয়নাঘরে নির্যাতন স্বাভাবিক করে ফেলা হয়। বিভিন্ন সভা, সেমিনার ও বইয়ের মাধ্যমে সমাজে এই বয়ানকে গ্রহণযোগ্য ও শক্তিশালী করতে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে বুদ্ধিজীবীরা।[২৩] তাদের সমর্থনকে পুঁজি করেই এতগুলো বছর ধরে হাসিনা তার গদি টিকিয়ে রেখেছিল। 

এছাড়াও জনপরিসরে এই ধারণা প্রচলিত আছে যে, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মতো শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ডেও ভারতের, বিশেষ করে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র’য়ের সম্পৃক্ততা রয়েছে। ‘৭১ এর পর থেকে বাংলাদেশে ভারতের হস্তক্ষেপ এবং জালিম হাসিনার প্রতি প্রত্যক্ষ সমর্থনের মতো বিষয়গুলো বিবেচনা করলে এমন ধারণা সত্যের নিকটতর বলেই মনে হয়।

শেষ কথা

৫-ই মে ছিল এদেশের ইতিহাসের টার্নিং পয়েন্ট। হাজার হাজার মুসলিম আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ভালোবাসায় দাঁড়িয়েছিল ইসলামের পক্ষে। আর জালিম ও তার বাহিনী দাঁড়িয়েছিল ইসলামের বিপক্ষে, শাতিমে রাসূলের পক্ষে, কুফরের পক্ষে। ৫-ই মে আলাদা করে দিয়েছিল ঈমান ও কুফরের তাবু। উন্মোচিত হয়ে গিয়েছিল জালিমের আসল চেহারা। ৫-ই মে’র পর এদেশে যখনই কেউ আল্লাহর রাসূলের অসম্মান করেছে, তখনই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণরা পর্যন্ত মাঠে নেমেছে। শাপলা আজও প্রাসঙ্গিক। যতদিন শাহবাগ থাকবে, ততদিন শাপলা থাকবে। যতদিন এ জমিনে ঈমান-কুফরের দ্বন্দ্ব থাকবে, ততদিন শাপলা থাকবে। 


রেফারেন্স:

১. Odhikar. (2013). Odhikar’s fact finding Report/5 and 6 May 2013/Hefazate Islam, Motijheel (pp. 7–9).

২.  Jagonews24.com. (2024, November 23) শহীদ রেহানের মা / ছেলের নিথর দেহ পড়ে ছিল মর্গে. https://tinyurl.com/4hz932yh 

৩. Wikipedia contributors. (2025b, March 30). 2013 Shahbag protests. Wikipedia. https://tinyurl.com/pkn6s46p  

৪. BBC News. (2013b, February 8). Huge Bangladesh rally seeks death penalty for war crimes. https://tinyurl.com/japmn2my 

৫. Gulf Times.  (2013, February 12). Bangladesh falls silent for execution of war criminals. https://tinyurl.com/5hmre6p8  

৬. Hasan, R. (2020, 3 April). The Genesis and Evolution of Hefazat-e-Islam. Fateh24.com. https://tinyurl.com/2tefxkbr 

৭. bdnews24.com. (2013, February 16). শাহবাগের পাশে দাঁড়ান : হাসিনা. https://tinyurl.com/3u2xhn27  

bdnews24.com. (2013, February 16). ‘সময় এসেছে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ার.’  https://tinyurl.com/5n89zz5j 

৮. Hasan, R. (2020, 3 April). The Genesis and Evolution of Hefazat-e-Islam. Fateh24.com. https://tinyurl.com/2tefxkbr 

৯. Wikipedia contributors. (2025b, March 31). An Open Letter from Shah Ahmad Shafi to the Government and the Public. Wikipedia. https://tinyurl.com/r4hvtf2b 

১০. Bangladesh: End violence over war crimes trials. (2020, October 28). Human Rights Watch. https://tinyurl.com/5n7x7fyk  

১১. Kallol, K. (2013, April 6). ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের বিশাল সমাবেশ, সোমবার হরতালের ডাক। BBC Bangla. https://tinyurl.com/9xjzn8jk 

১২. Assembly of Hefazate Islam Bangladesh and Human Rights Violations ODHIKAR. (n.d.). Retrieved April 6, 2025, from https://tinyurl.com/4dcnjtyk 

১৩. kanaksarwarNEWS. (2025, March 18). সেনাবাহিনীতে না থেকেও “কর্নেল থেকে মেজর জে:” পর্যন্ত হয়ে গেছে জিয়াউল আহসান | KanaksarwarNEWS [Video]. YouTube. https://tinyurl.com/mrchxxyp 

১৪.  Wikipedia contributors. (2025c, April 4). 2013 Shapla Square protests. Wikipedia. https://tinyurl.com/4977enjc  

১৫. Al Jazeera. (2013, May 14). Video suggests higher Bangladesh protest toll. https://tinyurl.com/2s4anurh 

১৬. Assembly of Hefazate Islam Bangladesh and Human Rights Violations ODHIKAR. (n.d.). Retrieved April 6, 2025, from https://tinyurl.com/4dcnjtyk 

১৭. GTV News. (2025, March 14). জিটিভির অনুসন্ধানে শাপলা চত্বর গণহত্যার রহস্য উন্মোচন! কতজন নিহত, জড়িত কারা? | GTV News [Video]. YouTube. https://tinyurl.com/82977ntd 

১৮. আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক. বাংলার আকাশে পরাধীনতার কালো মেঘ (নাস্তিক্যবাদ ও হেফাজতে ইসলাম প্রসঙ্গ), তাওহিদের ডাক, মে-জুন ২০১৩. https://tinyurl.com/yc37vndp  

১৯. Prothom Alo Facebook Status. (2013, May 6). https://tinyurl.com/4xt6b7hr 

২০. Wikipedia contributors. (2025c, April 4). 2013 Shapla Square protests. Wikipedia. https://tinyurl.com/4977enjc  

২১. Wikipedia contributors. (2025b, April 4). 2013 Shapla Square protests. Wikipedia. https://tinyurl.com/5bpsmkxn 

২২. Yamin A. B. (2014, February 4). ইতিহাসের হাত ধরে গণজাগরণ মঞ্চের ৩৬৫ দিন. Risingbd Online Bangla News Portal. https://tinyurl.com/zykcez3s  

২৩. Prothom Alo. (2017, December 16). বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে উগ্রবাদের প্রভাব প্রকট. https://tinyurl.com/52pkzcf7