তখন আমি একটা কোম্পানির হয়ে খাবার ডেলিভারি করতাম। আমাদের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা কোনোকালেই ভালো ছিল না। ছাত্র অবস্থায় তাই নানারকম পার্টটাইম জব করে একটু অতিরিক্ত টাকা কামানোর চেষ্টা করতাম। আমাদের উপমহাদেশের পার্টটাইম জবের ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে নেওয়া হয় না। ধরেন, কেউ যদি আমার আম্মাকে গিয়ে বলে, ‘আরে ভাবি, আপনার ছেলে তো বাড়িতে বাড়িতে খাবার দিয়ে বেড়ায়!’ আম্মা আমাকে ফোন করে কেঁদে বুক ভাসাবে। বলবে, ‘বাবা এইসব কাজ করিস না। দরকার হলে আমরা এক বেলা না খেয়ে তোকে আরেকটু বেশি টাকা পাঠাব। কিন্তু এগুলো করিস না।’
অদ্ভুত এক ব্যাপার! উপমহাদেশের বেশিরভাগ মানুষের উন্নতি না হওয়ার একটা বড় কারণ হলো আমরা সব পেশাকে সম্মান দিতে জানি না। তাই বাড়িতে আর জানাইনি যে, আমি পড়াশোনার ফাঁকে এসব কাজ করি। অনেক ফালতু বকে ফেললাম। এবার ঘটনায় আসি।
ঐ সময় আমার সঙ্গী ছিল একটা সাইকেল। ওটায় চড়ে আমি ঢাকার নানা জায়গায় খাবার ডেলিভারি দিতাম। যেদিনের ঘটনা সেদিন ছিল শুক্রবার, ছুটির দিন। মানুষ ছুটির দিনে বেশি খাবার খেতে ভালোবাসে, তাই সারাদিন প্রচুর অর্ডার এসেছিল। ব্যস্ত সময় কাটছিল আরকি। রাত পৌনে দশটার দিকে একটা অর্ডার এলো। কাবুলি পোলাওয়ের অর্ডার। খানা-দানা বিরিয়ানি ঘর-এর কাবুলি পোলাওয়ের বেশ হাইপ ছিল সেই সময়। অর্ডার পিক করতে করতে সাড়ে দশটা বেজে গেল। দ্রুত সাইকেল চালিয়ে ডেলিভারি দিতে চললাম। যে এলাকা থেকে অর্ডার এসেছিল, সেই এলাকা বেশ দূরে। তাই খুব দ্রুত সাইকেল চালাচ্ছিলাম। বেশি রাত হওয়ায় রাস্তায় জ্যামও ছিল কম। আধঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম সেখানে।
তারপর যে নাম্বার থেকে অর্ডার দেওয়া হয়েছিল, সেটায় কল করলাম। ওপাশ থেকে এক ভদ্রলোক ফোনটা ধরলেন, ‘হ্যালো।’ লোকটার গলা কেমন যেন খসখসে।
‘হ্যালো স্যার, জেব্রা থেকে বলছিলাম। আপনার কাবুলি পোলাও অর্ডার ছিল। আমি আপনার বিল্ডিংয়ের গলির সামনে দাঁড়িয়ে আছি।’
‘গলি দিয়ে ভেতরে চলে আসেন।’
‘স্যার, একটু যদি কাউকে পাঠাতেন গলির সামনে। রাত হয়েছে তো।’
‘না না, কাউকে পাঠানো যাবে না। আপনি গলির মধ্যে আসেন…’
এই বলে কল কেটে দিলো লোকটা। মেজাজ খুব খারাপ হচ্ছিল। কিন্তু কী আর করা! গ্রাহকের কথাই শেষ কথা। ঢুকে পড়লাম গলিতে। গলির একদম শেষ মাথায় মতিন ভিলা। বাড়িটা বেশ চকচকে, আলো ঝলমলে। নিচ তলায় কোনো গার্ড নেই, দরজাটাও খোলা! তাতে আমার কী? তাড়াতাড়ি ডেলিভারি দিয়ে কেটে পড়তে পারলেই হয়।
সাইকেলটা একপাশে রেখে তালা মেরে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলাম। দু’তলায় উঠে দেখি দরজার ডান পাশের একটা কাগজ ঝুলছে। আর তাতে লেখা, “দ্বিতীয় তলা।” দরজাটায় তালা ঝুলছে। এই “দ্বিতীয় তলা” লিখে রাখার কী দরকার? মানুষ তো এমনিতেই বুঝে, তাই না? বিরক্ত হয়ে তিন তলায় উঠলাম। এ কী! তিন তলাতেও একটা কাগজ ঝুলছে আগের মতো “দ্বিতীয় তলা” লেখা। এখানকার দরজাতেও তালা। ভদ্রলোক কি অর্ডার দিয়ে আমার সাথে মজা করছে নাকি? পকেট থেকে মোবাইল বের করলাম। ফোন দিতে হবে ওনাকে। কিন্তু নো নেটওয়ার্ক। আশ্চর্য ব্যাপার, একটু আগেও তো নেটওয়ার্ক ছিল! মোবাইলটা হাতে নিয়ে দু’তলায় নামলাম। না, নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না।
চার তলায় গিয়ে দেখব? পুরো বিল্ডিংটা কেমন যেন নিস্তব্ধ, কোনো শব্দ নেই! আচ্ছা, দু’তলা তিন তলা একদম একই রকম, কোনো পার্থক্য নেই। উঠলাম তিন তলায়। তারপর চার তলায়। চার তলাতেও সেই একই কাগজ ঝুলানো। লেখা “দ্বিতীয় তলা”। কী ব্যাপার! আবার সেই দ্বিতীয় তলা! এমন কেন হচ্ছে? তাড়াতাড়ি তিন তলায় নেমে এলাম, তারপর দু’তলায়। নিচ তলায় যেতে হবে। হয়তো গার্ড আশেপাশে কোথাও ঘুরতে গিয়েছিল, এতক্ষণে চলে এসেছে। কিন্তু কোথায় নিচ তলা? দোতলা থেকে নেমে আমি দেখি আবার সেই “দ্বিতীয় তলা” লেখা জায়গাটাতেই চলে এসেছি। এখান থেকেই না মাত্র নামলাম? নিচে নামতে শুরু করলাম আবার। আবার সেই একই জায়গাতে এসে পৌঁছলাম!
এই মুহূর্ত থেকে আমি ভয় পেতে শুরু করলাম। কিন্তু মাথা কাজ করছিল। দ্রুত পকেট থেকে কলমটা বের করে “দ্বিতীয় তলা” লেখা কাগজটিতে দাগ দিলাম। তারপর দৌড়ে গেলাম উপর তলায়। গিয়ে দেখি এখানেও “দ্বিতীয় তলা” লেখা কাগজটায় সেই দাগ। ব্যাপারটা যে ভূতুড়ে তা আর আমার বুঝতে বাকি রইল না। পাগলের মতো সিঁড়ি দিয়ে হাটাহাটি শুরু করলাম। ফোনে ইন্টারনেট নেই, ইন্টারনেট ঢোকানোর উপায়ও নেই! ঠিক তখনই কারেন্ট চলে গেল। গাঢ় অন্ধকার ঘিরে ধরল আমায়। কী করব এখন? যত দুআ-কালাম মনে পড়ল, সব পড়ে ফেললাম এক টানে। মোবাইলের টর্চ জ্বালানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু জ্বলল না। তখনই কারেন্ট চলে এলো! খুব দ্রুত নিচে নামলাম আমি। আরে, আমি নিচ তলাতে! গেটটা আগের মতোই খোলা। তাড়াতাড়ি বাইরে এসে চেপে বসলাম আমার সাইকেলটায়। দ্রুত চলে এলাম গলির মুখে। ডানদিকে একটা দোকান খোলা ছিল। গলা শুকিয়ে গিয়েছিল রীতিমতো। পানি খাওয়া দরকার। ‘ভাই, একটা ছোট মিনারেল ওয়াটার দিন তো’, বললাম দোকানিকে। দোকানদার মধ্যবয়স্ক। ফ্রিজ থেকে পানি বের করতে করতে আমাকে অপাদমস্তক দেখলেন তিনি।
‘ভাই কি খাবার ডেলিভারি করেন?’, বললেন তিনি।
‘হ্যাঁ ভাই, মতিন ভিলাতে গিয়েছিলাম।’
‘কী! মতিন ভিলা? ঐটা তো পাঁচ বছর ধরে বন্ধ… ।’