বস কেইম টু ডিনার

বস কেইম টু ডিনার

বাসায় আজ তুমুল ব্যস্ততা[1]। হাসান সাহেব তার বসকে ডেকেছেন ডিনারের জন্য। তিনি এবং তার স্ত্রী জেনিফার ঘাম মোছার সময়টুকু অব্দি পাচ্ছেন না। জেনিফার খুব সুন্দর করে সেজেছে। লম্বা গাউন, খোঁপা করা জটবাঁধা চুল। মুখে দেওয়া ভারী মেকআপ আস্তে আস্তে উঠে যাচ্ছে। এদিকে হাসান সাহেব সিগারেটের পর সিগারেট ধরাচ্ছেন। হাতে কাগজ কলম। এক রুম থেকে আরেক রুমে দৌড়াচ্ছেন। বিকেল পাঁচটার মধ্যে মোটামুটি একটা গোছগাছ করে ফেলেছেন তারা।

আচমকা চিন্তার রেখা দেখা দিল হাসানের কপালে। মাকে কী করব! এতক্ষণ পর্যন্ত এই ব্যাপারটা তার এবং জেনিফার; কারোই তো মাথায় আসেনি। হাসান স্ত্রীর দিকে ফিরে চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘মাকে কী করব?’

জেনিফার কাজ থামিয়ে চিন্তা করতে লাগল কী করা যায়। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, ‘পাশের ফ্ল্যাটে পাঠিয়ে দিব?’ হাসানের ঠোঁটে অনবরত দুলছে সিগারেট। একটু ভেবে সে বলল, ‘না। সেটা করা যাবে না। তারচে বরং মাকে বলি আজ রাতের খাবারটা তাড়াতাড়ি শেষ করে উনার রুমে চলে যেতে।’

হুম। হাসানের প্ল্যানটা জেনিফারেরও পছন্দ হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে জেনিফার জিজ্ঞেস করে উঠল, ‘কিন্তু উনি যদি ঘুমিয়ে যান এবং নাক ডাকা শুরু করেন? তখন কী হবে? তার উপর উনার রুমটা একবারে ডাইনিং রুমের পাশেই। অল্পতেই শব্দ শোনা যায়।’

‘আমরা উনাকে বলব দরজা বন্ধ করে দিতে। আর আমিও বাইরে থেকে লক করে দিব। এরচে ভালো হয়, আমি মাকে বলে দিব না ঘুমাতে।’ হাসান জেনিফারকে আশ্বস্ত করল।

মেয়ে মানুষের মন সহজে আশ্বস্ত হয় না। জেনিফার পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ল, ‘তিনি যদি ঘুমিয়ে পড়েন তাহলে? ডিনার কখন শেষ হবে কে জানে!’

একরাশ বিরক্তি এসে হাসানকে চেপে ধরল। হাসান শান্ত থাকার চেষ্টা করল। এখন উত্তেজিত হবার সময় নয়; ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে। হাসান তার মায়ের রুমের দিকে তাকাল। রুমটা বারান্দার দিকে খোলা। বারান্দার দিকে চোখ পড়তেই হাসানের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলল।

‘পেয়ে গেছি!’ এই বলে সে দ্রুত তার মায়ের রুমের দিকে গেল। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে, ছোট্ট একটা মোড়ায় বসে তসবিহ গুনছেন হাসানের মা। আসরের নামাজ শেষ করে তিনি এই সময়টায় বারান্দায় বসেন। গুনগুন করে দুআ দরুদ পড়েন। মনোয়ারা বেগম নিতান্তই সহজ সরল গ্রামীণ মহিলা। শহুরে ঝড় ঝাপটা তার ভালো লাগে না। সকাল থেকেই মনোয়ারা বেগম ছেলে আর ছেলের বউয়ের এই ব্যস্ততা নিয়ে বেশ ভয়ের মধ্যে আছেন। না জানি উনার কারণে ছেলেকে বিব্রত হতে হয়। শুনেছেন অফিসের নাকি কোন বস আসবে বাসায়। মনে মনে তিনি দুআ করেন সব যেন ঠিকঠাক ভাবে হয়ে যায়।

‘মা, আজকে রাতের খাবারটা একটু তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ো। মেহমানরা সাড়ে সাতটায় আসবেন।’

মনোয়ারা বেগম পেছনে তাকিয়ে দেখলেন হাসান দাঁড়িয়ে আছে। তিনি নামাজের ওড়নাটা একটু মুখ থেকে সরিয়ে উত্তর দিলেন, ‘বাবা, আজকে তো আমি ইফতারিতেই রাতের খাবার খেয়ে ফেলব। সোমবারে আমি রোজা রাখি, জানো তো।’

‘যাই হোক।’ হাসানের মুখে বিরক্তির ছাপ। ‘শুনো মা! আরেকটা কথা। মেহমানরা আসলে আমি উনাদেরকে ড্রয়িং রুমে বসাবো। ততক্ষণ তুমি একটু বারান্দায় থেকো। পরে আমরা যখন বারান্দার দিকে যাব, তুমি আস্তে করে বাথরুমের দরজা দিয়ে ড্রয়িং রুমে চলে যেয়ো।’

মনোয়ারা বেগম চুপসে গেলেন। কাতর স্বরে ছেলেকে আশ্বস্ত করলেন, ‘আচ্ছা বাবা।’

কিছুটা ধমকের সূরে হাসান বলল, ‘মেহমানরা যাওয়ার আগে ঘুমিও না। তুমি ভীষণ জোরে নাক ডাকো।’

‘আমি কী করব, বাবা? বয়সের কারণে বেশিরভাগ সময় অসুস্থ থাকি। তাই ঘুমানোর সময় নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।’

বৃদ্ধ মায়ের অপারগতার উত্তর হাসানের পছন্দ হয় না। হাসানের মনের মধ্যে খুঁতখুঁত করছে। প্ল্যানটা কি আদৌ কাজ করবে! কী হবে, বস যদি নিজে থেকে গিয়ে বারান্দায় উঁকি দেন?

মনোয়ারা বেগম আতঙ্কে তসবীহ গুনে যাচ্ছেন। ছেলেকে খুব ভয় পান তিনি। নামাজের ওড়নাটা একটু ঠিক করে তিনি চেয়ারে বসলেন।

মায়ের পায়ের দিকে চোখ পড়ল হাসানের। ‘ভালো কথা, তুমি কী পরবে আজ?’

‘আমার যা আছে আমি তা পরব বাবা। তুমি যা বলবে, তা পরব।’ মায়ের কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে এলো।

হাসানের ঠোঁটে এখনো সিগারেট দুলছে। হাসান এক চোখ বন্ধ করে তার মাকে মাথা থেকে পা অব্দি পর্যবেক্ষণ করল। পাছে মায়ের কোনো কমতি মেহমানদের চোখে পড়ে যায়। কত লজ্জার ব্যাপার হবে তখন! হাসান তার মাকে হুকুম করল, ‘তুমি তোমার কালো পাড়ের জামদানি শাড়িটা পরে আসো।’

মনোয়ারা বেগম আস্তে করে উঠে রুমে চলে গেলেন।

মনোয়ারা বেগম শাড়ি পরে আসলেন। ক্ষীণ-কম্পিত-নিষ্প্রভ মায়ের চোখজোড়া। সেই চোখের ভাষা হাসান বুঝতে পারে না। চুলগুলো ঠিকমতো আচড়ানো হয়নি। দেখে মনে হচ্ছে, আগের আর এখনকার অবস্থার মাঝে খুবেকটা পার্থক্য নেই।

হাসান খটকা নিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার হাতের বালাগুলো কোথায়, মা?

‘ওগুলো তো নেই বাবা। তুই তো জানিস, তোর পড়ালেখার জন্য ওই বালাগুলো বিক্রি করে দিতে হয়েছিল।’ মনোয়ারা বেগম আক্ষেপ করলেন।

‘হয়েছে। হয়েছে। রাখো এবার। কিছু একটা বললেই এমন ন্যাকাকান্না জুড়ে দাও কেন? সোজা বাংলায় বললেই তো হয় যে বালা নেই। সবকিছুর মধ্যে পড়ালেখার কথা টানতে হয় কেন? আর বালাগুলো তো একটা ভালো কাজের জন্যই বিক্রি করা হয়েছিল, তাই না? আমি রাস্তার ছেলেপেলে নই মা। তোমার টাকা দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দিব আমি সব।’ হাসান একনাগাড়ে সব বিরক্তি উগড়ে দিল।

‘কী বলিস এসব! খোদা! মা কি কখনো সন্তানের কাছ থেকে বিনিময় আশা করতে পারে!’ মায়ের গলা কাঁদোকাঁদো।

ঘড়ির কাটা ছ’টার কাছাকাছি ঝুলে আছে। হাসান গোসল করে গায়ে একটা ভালো স্যুট চাপিয়ে দিল। জেনিফার তার রুমে রেডি হচ্ছে। রুম থেকে বের হওয়ার আগে হাসান তার মাকে আরেকবার সতর্ক করে দিল, ‘মা, সবসময়ের মতো চুপ মেরে বসে থাকবে না। যদি বস তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করে, উত্তর দিবে ঠিকমতো। আমি বলে দিব কী বলতে হবে।’

মনোয়ারা বেগম বুঝতে পারে না কিছু। কাতর ভঙ্গিতে বলে, ‘আমি অশিক্ষিত মানুষ, বাবা। আমি পড়তে লিখতেও পারি না। যদি কোনো সমস্যা না হয়, তুমি তাদেরকে বলে দিতে পারো তোমার মা একটা মূর্খ।’

সময়ের স্রোত গড়িয়ে যায়। মায়ের মাথায় ভর করে চিন্তার পাহাড়গুলো। বৃদ্ধবুক ধড়ফড় করে শুধু। যদি ছেলের বস এসে তাকে ইংরেজিতে কিছু জিজ্ঞেস করে, কী হবে! ইংরেজির ই জানা নেই তার। তার উপর বস নাকি অ্যামেরিকান সাহেব। কপালে চিকন ঘামের রেখা লুকোচুরি খেলে।

হাসানের ডিনার আয়োজন একদম স্বার্থক। আলোচনা এখন তুঙ্গে। প্রতি গ্লাস ড্রিংকের সাথে পালটে যাচ্ছে টপিক। একবার একটা। অ্যামেরিকান সাহেব বসও ডিনার খুব পছন্দ করেছেন। মেমসাহেবেরও ঘরের পর্দা থেকে শুরু করে সবকিছু সাজানো পছন্দ হয়েছে। এরচে ভালো আর কী হতে পারে হাসানের জন্য! বসের উচ্ছ্বাসের যেন কমতি নেই।

সময় কীভাবে চলে যাচ্ছে কেউ বুঝতে পারল না। সাড়ে দশটা বেজে গেছে। সবাই ড্রয়িং রুম থেকে বেরিয়ে এলো। হাসান সাহেব সবাইকে এগিয়ে দিচ্ছেন। বারান্দায় পৌঁছাতেই হাসান খানিকটা থমকে দাঁড়াল। এ কী দেখল সে! তার পা গুলো যেন দুর্বল হয়ে পড়ছে। মুখের হাসি কর্পূরের মতো উবে গেল। মনোয়ারা বেগমকে সে যেখানে রেখে এসেছিল, তিনি এখনো সেভাবে, সেখানেই বসে আছেন। কিন্তু তার পা দুটো সামনে রাখা চেয়ারের ওপর মেলা। মাথা ঝুলে আছে শূন্যে। ঘুমে ঢলে পড়ছেন এ পাশ থেকে ওপাশে। ভয়ংকরভাবে তিনি নাক ডাকছেন।

হাসান রাগে ফেটে পড়ছে। তার ইচ্ছে করছে এখনই গিয়ে একটা ধাক্কা মেরে মনোয়ারা বেগমকে তুলে দিতে। এরপর রুমে পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু বস এবং বাকি অতিথিরা সবাই দাঁড়িয়ে—কীভাবে কী করবে সে!

অতিথি মহিলারা মিটিমিটি হেসে বলল, বেচারি!

মনোয়ারা বেগমের ঘুম ভাঙল। তিনি হতবিহ্বল হয়ে পড়লেন। এতগুলো মানুষকে একসাথে দেখে এতটাই ভয় পেলেন যে, তার মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের হলো না। তিনি হিজাব টেনে নিলেন। নিচু হয়ে উঠে তাদের সামনে দাঁড়ালেন। হাত পা কম্পমান…

‘মা, ঘুমাতে যাও। তুমি এত রাত অব্দি জেগে আছ কেন?’ হাসানের ভণিতামাখা প্রশ্ন।

সাহেব বস যেন উপভোগ করছেন সব। তিনি মুচকি হেসে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বিদেশি অ্যাকসেন্টে সালাম দিলেন।

মনোয়ারা বেগম যেন সংকুচিত হয়ে পড়লেন। অনেকটা আতঙ্কিত মনকে সামাল দিয়ে মাথা নিচু করে সালামের উত্তর দিলেন।

সাহেব বস এতক্ষণ মায়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। মৃদুভাবে হাসছেন যেন তিনি মনোয়ারা বেগমকে খুব পছন্দ করেছেন। পৃথিবীরের সব মায়ের মাঝেই কি একই রকম মায়া? সেই মায়া বোধহয় অ্যামেরিকান সাহেবকেও ঘায়েল করে ফেলেছে।

তিনি মনোয়ারা বেগমকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন আছেন মা?’

পাশ থেকে হাসান অনুবাদ করে দিচ্ছে। ‘মা, তোমাকে কেমন আছ জিজ্ঞেস করছে। উত্তর দাও না।’

মনোয়ারা বেগম কিছু একটা বিড়বিড় করলেন। পেছন থেকে কেউ একজন হাসি আটকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে।

সবাই বিরক্ত হলেও সাহেব বস খুব সুন্দরভাবে সামলে নিলেন। তিনি এক পলকে মনোয়ারা বেগমের দিকে তাকিয়ে আছেন। যেন কত মমতামাখা সাক্ষাত!

হাসান নিরবতা ভাঙল, ‘স্যার। আমার মা গ্রামে থাকে। তিনি তার পুরো জীবন ওখানেই কাটিয়েছেন। তাই একটু লজ্জা পাচ্ছেন।’

‘আসলেই কি?’ সাহেবের মুখে যেন হাসি ফুটলো। ‘গ্রামের মানুষ আমার খুব ভালো লাগে। আমার মনে হয়, গ্রামের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী জিনিস সম্পর্কে আপনার মা খুব ভালো ধারণা রাখেন। আমি আবার গ্রামীণ বিষয়গুলোতে আগ্রহী অনেক।’  বলতে বলতে মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন।

হাসান আগ বাড়িয়ে বলল, ‘মা, সাহেবকে গ্রামীণ কিছু বিষয় সম্পর্কে বলো।’

‘আমি কী বলব, বাবা? আমি তো কিছু জানি না তেমন।’ মনোয়ারা বেগম দুর্বল কণ্ঠে বললেন।

‘মা, অতিথির আবদার ফেলে দিবে? তুমি না বললে, সাহেব লজ্জিত হবেন। দেখো, তিনি অপেক্ষা করছেন।’

‘কিন্তু, আমি তো…’

হাসানের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। অসহায় মা সেটা বুঝতে পারলেন। কোনো রকমে ভাঙাচোরা গলায় বলতে শুরু করলেন। কীভাবে তারা গ্রামে জীবন যাপন করতেন, ছোটবেলায় নদীতে সাতরাতেন, মাছ ধরতে যেতেন, বাবার হাত ধরে পিচ্চিকালে হাটে যেতেন, ঈদগাহে যেতেন। এরপর গ্রামের মহিলাদের জীবনব্যবস্থা। কৃষিকাজ, পশুর লালন পালন, ধানকাটা, বিভিন্ন ফসলাদি চাষ করা, আরও কত কিছু।

হঠাৎ হাততালিতে ভরে উঠলো রারান্দা। সাহেব বসের তালি থামার নাম নেই। তিনি মহাখুশি হয়েছেন। হাসানের রাগ ক্ষোভ মুহূর্তেই বদলে গেল উচ্ছাসে। বৃদ্ধ, গেঁয়ো মনোয়ারা বেগম যেন পার্টির মোড় ঘুরিয়ে দিলেন।

শোরগোল থেমে গেলে, সাহেবের চোখ পড়ল মায়ের রুমে রাখা নকশিকাঁথার দিকে। গ্রামীণ নিদর্শন। এটা মনোয়ারা বেগমের নিজের হাতে বানানো। সাহেব অতি আগ্রহের সাথে আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করলেন।

হাসানের মুখ এখনো খুশিতে জ্বলজ্বল করছে। কানে তালির শব্দ বাজছে। হাসান সাহেবকে বলল, ‘এগুলো নকশি কাথা। আমার মায়ের হাতে বানানো। গ্রামীণ মহিলারা অবসরে এগুলো বানান। আপনার জন্যে আমি আলাদা করে সেলাই করিয়ে অফিসে নিয়ে যাব।’

ক্ষীণ আশা নিয়ে সে মাকে জিজ্ঞেস করল, ‘মা, আমাদের বাসায় আর কোনো নকশিকাঁথা আছে?’

মনোয়ারা বেগম আশাহত গলায় বললেন, ‘না বাবা। আর তো নেই।’

হাসান সাহেবকে অতি উৎসাহের সাথে বলল, ‘আমি আপনার জন্য নতুন একটা বানিয়ে আনবো। মা, তুমি সাহেবের জন্য সুন্দর করে একটা কাথা সেলাই করে দিবে।’

মনোয়ারা বেগম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘আমি এখন খুবেকটা চোখে দেখি না। বয়সের সাথে সাথে চোখের জোর কমে গেছে।’

‘মা, তুমি অবশ্যই সাহেবের জন্য একটা বানাবে। যেভাবেই হোক।’ হাসান জোর করল।

সাহেব কিছু বুঝল না। তিনি মাথা নাড়িয়ে মনোয়ারা বেগমকে ধন্যবাদ জানালেন। এরপর সবাই মিলে ডাইনিং টেবিলের দিকে চলে গেল আবার।

অতিথিরা যখন সবাই খেতে বসলেন, মনোয়ারা বেগম তার রুমে চলে গেলেন। একদম নিঃশব্দে। যখনই তিনি নিজের রুমে এলেন, তার চোখ দিয়ে অজস্র ধারায় অশ্রু ঝরতে শুরু করল। কম্পমান হাতে তিনি চোখ মুছে যাচ্ছেন। কিন্তু কান্না যেন থামছেই না। যেন, হাজার বছরের চেপে রাখা বেদনারা একে একে নিংড়ে পড়ছে। তিনি নিজেকে সামলে নিতে চেষ্টা করলেন। তিনি হাত দুটো জড়ো করে আল্লাহর কাছে হাত তুললেন। ছেলের দীর্ঘায়ু কামনা করে দুআ করলেন। কিন্তু, কী হলো আজ! আষাঢ়ের ঝুম বৃষ্টির মতো অশ্রু ঝরছে… থামার নাম নেই।

প্রায় মাঝরাতের দিকে অতিথিরা এক এক করে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু মনোয়ারা বেগম এখনো তার রুমে দেয়ালে পিঠ ঠেকে বসে আছেন। সকল উচ্ছাস ফিকে হয়ে আসছে, ঘর খালি হয়ে যাচ্ছে। সব অতিথিরা চলে গেল।

কিছু প্লেট টেবিল থেকে সরানোর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।  এমন সময়ে কেউ একজন দরজায় কড়া নাড়ল, ‘মা, দরজা খোলো।’

তার মন আঁতকে উঠল। তিনি কি আরেকটা ভুল করে বসলেন মনের অজান্তে? সেই ভুলের জন্য কি হাসান এখন তাকে শাসাতে আসবে? কাঁপাকাঁপা হাতে তিনি রুমের দরজা খুলে দিলেন।

দরজা খুলতেই হাসান খুব উচ্ছাসের সাথে বলল, ‘মা, তুমি আজকে অনেক ভালো করেছ। সাহেব তোমাকে নিয়ে অনেক খুশি হয়েছে। মা, তুমি সবচেয়ে সেরা মা।’

মনোয়ারা বেগমের ছোট্টোখাট্টো শরীর যেন ছেলের এত বড় প্রশংসার সামনে আরও ছোট হয়ে আসলো। চোখ পানিতে ভিজে উঠল। চোখ মুছে তিনি বললেন, ‘আমাকে দেশে দিয়ে আয়। আমি এখানে থাকব না আর।’

হাসানের চেহারা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। ‘কী বললে মা তুমি? আবার সেই এক কথা!’

হাসানের রাগ ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। ‘তার মানে, তুমি আমাকে সবার কাছে ছোট করতে চাও? সবাই যেন ভাবে, আমি তোমাকে আশ্রয় দিইনি?’

‘না বাবা। আমাকে ভুল বুঝছিস। তুই তোর স্ত্রী সংসার নিয়ে ভালো থাক। আরামে থাক। আমি আমার জীবনের শেষ সময়ে চলে এসেছি। এখানে থেকে কী করব আমি!’ মনোয়ারা বেগম চোখ মুছতে মুছতে বললেন।

‘তুমি যদি চলে যাও, সাহেবের জন্য নকশিকাঁথা কে বানিয়ে দেবে?’ হাসানের রাগ বেড়ে যাচ্ছে।

‘বাবা, আমার দৃষ্টি কমজোর হয়ে পড়েছে।’ মনোয়ারা বেগম ছেলেকে বুঝাতে ব্যর্থ হচ্ছেন।

‘দেখো মা। তুমি আমাকে এভাবে ছোট করতে পারো না। তুমি কি নষ্ট করে দিতে চাও সবকিছু? সাহেব যদি খুশি হন, তিনি আমার পদোন্নতির ব্যবস্থা করবেন। আমি আরও উঁচু জায়গায় যেতে পারব।’

মা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। আচমকা তিনি বললেন, ‘সত্যিই তোর পদোন্নতি হবে? তিনি কি আসলেই বলেছেন এটা?’

হাসান মাকে বুঝাতে শুরু করল, ‘তুমি দেখোনি তিনি কতটা খুশি হয়েছেন? তিনি বলেছেন, যখন তুমি কাঁথা সেলাই করবে, তিনি আমাদের বাসায় এসে স্বচক্ষে দেখে যাবেন সেটা। সাহেব যদি খুশি হন, আমি হয়তো অনেক বড় কোনো পজিশনে যেতে পারব, মা।’

বোকা মায়ের মন নিমিষেই যেন ভালো হয়ে গেল ছেলের পদোন্নতির কথা শুনে।

‘তাহলে তুই অনেক ভালো জায়গায় যাবি?’

‘এটা এতটা সোজা না, মা। তুমি যদি শুধু সাহেবকে খুশি করতে পারো, তবেই সম্ভব। অফিসে অনেকেই আছে। সবাই-ই তো ভালো অবস্থানে যেতে চায়, মা। কিন্তু আমি এখন একটা বড় সুযোগ পেয়েছি। এটা কাজে লাগাতে হবে তো।’ হাসান মাকে বুঝিয়ে বলল।

‘ঠিক আছে। আমি তোর সাহেবের জন্য নিজ হাতে নকশিকাঁথা বানিয়ে দিব। আমি চোখে অতটা না দেখতে পেলেও, কষ্ট করে বানিয়ে দিব।’ এরপর তিনি ছেলের জন্য দুআ করলেন।

‘ঠিক আছে। ঘুমিয়ে যাও মা।’ রুম থেকে বের হওয়ার সময় হাসান বলল।

মনোয়ারা বেগম সব ভুলে গেলেন। ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে খুশি হতে লাগলেন।

পৃথিবীর সব মায়েরাই কি এমন বোকা?


[1] বিদেশি গল্প অবলম্বনে।

ষোলোকে ছড়িয়ে দিন