২২ সেপ্টেম্বর, ১৮৯২
মিরা
জানালায় কতগুলো হলুদ জবা। হালকা বেগুনি রঙের ফুল, এগুলোর নাম কী? হুম, সসেজ হতে সময় বেশি লাগবে না। দ্রুত যেতে হবে উলটে দিতে। বাজলামার ড্রেসিং করা হয়নি। রাতে মার্ত আজকে আগে আসবে বলেছিল, হাতে তিন ঘণ্টার মতো সময় আছে। অনেক সময়, চিন্তা নেই।
সসেজ ভাজার সুবাস ঘরময় মৌ মৌ করছে। মিরা চারটা সসেজ তুলে রাখল। কন্সটিন্টিনোপোলের সৌন্দর্যের একটি অংশ হলো এ শহরের প্রতিটা বাড়ির জানালায় সাজিয়ে রাখা ফুল। এত রং, এত ভিন্নতা, এত আভিজাত্য বোধহয় এখানের মানুষেরাও অভ্যস্ততার কারণে বুঝতে পারে না। চওড়া বর্ডারের ছোট ছোট টব। কিছু ঝুলছে জানালার চারপাশ ঘিরে। মিরা মাঝে মাঝে অবাক হয়। কৈশোরে সে ভাবত, মানুষ যা চেনে না তা কি ভালোবাসতে পারে? সে তো নীল ফুলগুলোর নাম জানে না। সে কি বলতে পারবে সে এগুলো ভালোবাসে না?
নিজের জটিল চিন্তায় নিজেই হেসে উঠল মিরা। জানালার বাইরে, মিরাদের বাসার পাশ ঘেঁষে একটা কবরস্থান। রাস্তা থেকে একটু ভেতরে। কবরস্থানটার পাশে বিশাল জায়গা ফাঁকা, কবর বাড়াতে হলে ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। তবে বাচ্চারা ঠিকই খেলার জন্য জায়গাটি বেছে নিয়েছে। বাচ্চাদের কারণেই হোক আর দীর্ঘদিন থাকার কারণেই হোক, এই জায়গাটার প্রতি মিরার ভয় বা অনাগ্রহ কাজ করে না। কেরেমের বন্ধুরা খেলছে, মিরা জানালা থেকে দেখছে ওদের। জুসের একটা বোতল রেখে এর ওপর পা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে একজন। চোখ বন্ধ করে দশ থেকে উলটো গুনবে সবাই। … ৩, ২, ১, কিক! বোতলে লাথি। ভোঁ দৌড় সবাই। বোতলটা ছিটকে পড়েছে কবরের কোনো এক প্রান্তে। প্রস্তরের ফলক বা কোনো কাঁচা-সদ্য খোঁড়া কবরে আটকে যেতে পারে। খুঁজতে হবে সবাই মিলে। যে আগে বোতল খুঁজে পাবে, সে হবে বিজয়ী। মিরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে বাচ্চাদের। খেলতে খেলতে হাঁপিয়ে গিয়েছে সবাই। তবুও কারও কোনো ক্লান্তি নেই।
নামহীন ল্যাভেন্ডার ফুলগুলোতে পানি দিতে দিতে হঠাৎ মিরা লক্ষ্য করল কেরেম কোথাও নেই। বোতল তো পাওয়া গিয়েছে, আরেক দফায় লাথি মারবে বাচ্চারা। কিন্তু কেরেম?
জেভ-সাদ-ওসমান-জান
জেভ: এই কেরেম প্রতিবার চিট করে। ওকে আমরা খেলায় নেবো না।
জান: বোতল মারার সময় কীভাবে এক চোখ খোলা রাখে দেখেছিস, জেভ?
সাদ: তাহলে তুই কি কম চোর নাকি? কেরেমের চোখ খোলা সেটা তুই চোখ না খুলে দেখলি কীভাবে?
জেভ: আমিই চোর ধরলাম আর আমাকেই চোর বানানো হচ্ছে? তুই কেরেমের হয়ে কথা বলছিস কেন?
– সবাই চুপ! থাম প্লিজ! কেরেম আসলে কোথায়?
ওসমানের কথায় সবার হুঁশ ফিরল। আসলেই তো! কেরেম কোথায়? যে বার জান ১৩২ নম্বর কবরের পেছনে বোতল পাঠিয়ে দিয়েছিল, এরপরের দুটো রাউন্ডের একটাতেও কেরেম খেলেনি। বসে ছিল আশেপাশেই। খেলতে খেলতে কেউ খেয়ালই করেনি যে কেরেম ওদের সাথে নেই।
সাদ: এখানেই তো ছিল। কোথায় গেল?
জেভ: কোথায় আর যাবে? কোনো কবরের পাশে বসে আছে হয়তো। একেকটা কাজ করে খুব সাহসী সাজতে চায়। ভাবের শেষ নেই।
জান: আমি জানি, আমি জানি! ওই যে সাদা ফলকওয়ালা কবরটা। ওখানে বসে থাকে ও।
ওসমান: ওই যে মৃত্যুসাল লেখা নেই যেটায়?
২১৮টি কবর, সঙ্গে ২১৮টি ফলক। নাম, পরিচয়, জন্ম-মৃত্যু, পরিবারের সদস্যবৃন্দের নাম, অনেক কিছুই লেখা আছে প্রতিটা ফলকে। অদ্ভুতভাবে ১৩২ নম্বর ফলকে অন্য তথ্য থাকলেও নেই মৃত্যুর দিন-তারিখ।
কেরেম
হাতঘড়িতে ৬টা বেজে ১২ মিনিট। ইশ, এতক্ষণ বসে আছি! না, না, এটা মনের ভুল হতে পারে না। আমি নিশ্চিত না হয়ে যাব না আজকে, কোনোভাবেই না। পরশু সন্ধ্যার কথা আমি কোনোদিন ভু্লতে পারব না। গতকাল আন্নেম১ ডেকে না নিলে বাসায় ফিরতামই না।
‘খোলো! খোলো!’
ওই তো সেই শব্দটা! এখন আমি কী করবো?
১৩২ নম্বর কবরের ফলকটা নড়ছে। কেউ অনবরত ধাক্কা দিচ্ছে কবরে। অন্ধকার হয়ে এসেছে প্রায়। নীরবতার শব্দে শন-শন করছে কবরস্থান। মৃত মানুষের নৈঃশব্দের মাঝে ধাপ ধাপ শব্দ করছে ১৩২ নম্বর। আলগা হয়ে আসছে মাটি। এর আগে কেরেম এমন মুহূর্তে পালিয়ে গিয়েছিল। একই ভুল সে এবার করতে চায় না। এগিয়ে যায় সামনে। মাটি হাত দিয়ে খুঁড়তে থাকে। গোঙানির শব্দ বাড়ছেই। কেরেম বুঝতে পারে না, সে কি নিজেই গোঙাচ্ছে? মানুষ মরে গেলে হাতে রক্তচাপ টের পাওয়া যায় না। কিন্তু প্রায়শই মৃতের আত্মীয়রা রক্তচাপ টের পায় হাত দিয়ে। এটা আসলে তার নিজেরই রক্তচাপ। কোনো একটা কারণে মৃত মানুষের শরীরে নিজেরটাই প্রতিফলিত হয়। বাবা বলেছে, বড় হলে বায়োলোজিতে সে পড়তে পারবে। কেরেম একই ভুল করছে না তো?
খপ!
অর্ধগলিত একটা হাত কেরেমের হাত টেনে ধরেছে। শরীরের সব শক্তি দিয়েও কেরেম পেরে উঠছে না হাতটার সাথে। টেনে নিচ্ছে কফিনের কাছে। সূর্য ডুবে গেছে, কাঠের কফিনের উপর ছিটকে পড়েছে কেরেম।
‘খোলো! খোলো!’
কেরেম বুঝতে পারছে কষ্ট, ব্যাথায় গোঙাচ্ছে সে নিজেই। চোখ ফেটে রক্ত বের হচ্ছে নাকি অশ্রু? কেরেম শব্দ করতে পারছে না একবিন্দুও। শ্বাস আটকে গেছে গলায়, কফিনের তালায় বারবার বাড়ি খাচ্ছে কেরেম। চার আঙ্গুলের হাতটা কেরেমকে টেনে ঢুকাতে চাইছে কফিনে, শরীরের শেষ শক্তিটুকু হারিয়ে পুরোপুরি ছেড়ে দিতে যখন যাচ্ছিল, অন্ধকারের মাঝে আরেকটা হাত ওপর থেকে ওর ঘাড়ে চাপ দিলো। এটা কি মৃত্যুর ফেরেশতা? ঘাড়ের ব্যথায় কেরেম চিৎকার করল সজোরে। তবে সে শব্দ মানুষের শ্রবণসীমার বাইরে, অথবা কেরেমের কল্পনা…
(চলবে ইনশাআল্লাহ…)
১. আন্নেম – আমার মা